সমস্ত স্বচ্ছল মধ্যবিত্ত শিশুর জীবনের মত আমার ছোটোবেলাও ছিলো চমৎকার সব মিথ্যে দিয়ে ভরা। আমার বাপ মা ঝগড়া করেছে ঠিকই, সন্ধ্যের দিকে ভাবও করে নিয়েছে ঝটপট। আমার ঠাকুমা, মানে আমি আম্মা ডাকি, গল্প বলে ঘুম পাড়িয়েছে রাতের পর রাত; দাদাই মানে ঠাকুরদাদা আমার, তিনি ছিলেন যেমন বটবৃক্ষের মত স্থির তেমন পরিমাণ মত ভুঁড়িও ছিলো বেশ; চন্দননগরের বাড়িতে পার্টির মিটিং হত, সেইসব ঘরে কাপের পর কাপ চা যেত আর ঘর থেকে বাইরে আসত শব্দ, সময়ের শব্দ, দেশ-কাল-সময়ের শব্দ, আর দাদাই তখন কী গম্ভীর, কিন্তু রাত্তির হলে আমাকে পিঠে চাপিয়ে বাবা মার ঘর অবধি দিয়ে আসত এই পুরুষই। আমি স্কুলের পরীক্ষায় টপাটপ ফার্স্ট হতাম আর নাচ শিখতাম আর গান গাইতাম আর বই পড়তাম। যদিও আমি চন্দননগরে বড় হইনি, তবে যে বাড়িতে আমার ছোটবেলার মস্ত সময় কাটে সেখানে বই ছিলো হাজার দশেক, আর চন্দননগরে তো আরও অনেক বেশি। সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে পিযুষকান্তি ছিলো টেপরেকর্ডারে আর কাঠের হোমিওপ্যাথির বাক্সে লাইন দিয়ে অধিষ্ঠান করত নাক্সভোমিকা, কার্বোভেজ, আর্নিকা, প্রমুখ। লোডশেডিং-এ বারান্দায় বসে বাবার সাথে গান গাইতাম, মা ভালো কেক বানাত। জন্মদিনে বিস্তর লোক পোলাও খেতো। সাইকেল চালাতাম, উদ্দাম আছাড় খেতাম, লাল ওষুধ ছিলো হাঁটু জুড়ে। বাড়ির পিছনে খেলার মাঠ ছিলো, বাড়িতে বারান্দা ছিলো। মাঠে খেলতে আসত একজোড়া চোখ, গান গাওয়ার সময় যে চোখগুলো বুজে আসত, দেখতাম। তখন প্রথম চাপ ছিলো। মানে যেরকম হয়। এক্কেবারে যেরকমটা হয়ে থাকে আর কি। এই গোত্রের ছোটোবেলাতে বিচ্ছেদ থাকে না, মানুষেরা সব বেঁচে থাকে আর সব পরীক্ষা ভালো হয়। বেঁচে থাকাটা যে মোটের ওপর ফুর্তির ব্যাপার এই নিয়ে কোনও সন্দেহই প্রায় থাকে না।
তবে আমি কখনোওই পুরোপুরি বিশ্বাস করিনি। প্রথম খটকা আমার লেগেছিলো বাংলা কোয়েশ্চেন পেপারে। যখন দেখলাম নানাবিধ প্রশ্নপত্র জুড়ে আনাচে কানাচে সব ‘ড্যাশ’ আর মোটামোটা অক্ষরে লেখা থাকছে: শূন্যস্থান পূরণ কর। মনে মনে আওড়ালে হুমকির মত শোনাতো। তখন নম্বরের লোভে ঝুপঝাপ শব্দ বসিয়ে কেল্লা ফতে হতো ঠিকই, কিন্তু, মনে হতো এখানেই শেষ নয়। প্রথম শূন্যস্থানের প্র্যাকটিকাল হলো রূপালী মিস মরে গেল যেদিন। রূপালি মিস কম্পিউটারের মিস। বাসে যেতে যেতে বাইরে হাত বার করেছিলো নাকি, ডান হাত, লরির সাথে ধাক্কায় কেটে বেরিয়ে গেছিলো। খবরটা দিয়েছিলো কি মা? মনে নেই স্পষ্ট। মনে আছে কেউ বলছিলো, রূপালী মিস ঘটনার পর ওর দাদাকে দেখে প্রথম বলে, “দাদা রে, এবার বাঁ হাত দিয়ে কম্পিউটারটা অভ্যাস করতে হবে।” আমার এটা শুনে এখনও মনে হয়, এটা বলার সময় উনি হাসছিলেন। রূপালি মিস সবসময় হাসতেন। তবে বাঁচানোই যায়নি আর। দুটো হাত, পা, ধারালো ব্রেন, ওই হাসিটা, কোনওটাকেই বাঁচানো যায়নি। রূপালি মিসের শূন্যস্থান পূরণ করতে এসেছিল যে তার নাম মনে নেই। কিন্তু মনে আছে সেদিন থেকে শূন্যস্থানের আকার পাল্টালো জীবনে, কোয়েশ্চেন পেপারের ড্যাশগুলো রাতারাতি চেহারা পাল্টে একটা জ্যান্ত পূর্ণাঙ্গ মানুষের মত দেখতে হলো।
তারপর? তারপরও যেরকম হয়। দাদাই বুড়ো হয়ে যায় আর সাম্যবাদেরও বয়স হয়ে গেলো। দাদাই প্রথমে ছাড়ল সাইকেল তারপর রাজনীতি। আম্মা পুরোনো গল্পই বারবার বলতে লাগলো। বাড়ির পিছনের মাঠ আর বারান্দা আর সবুজ টাউনশিপ ছেড়ে আমরা পাকাপাকি এলাম চন্দননগরে। এইসবে অনেকদিন কেটে গিয়েছে যখন তখন একদিন বুঝলাম শূন্যস্থানটাকে অবিকল ছোটোবেলার মত দেখতে হয়ে গিয়েছে কখন, টেরই পাইনি।
এইসমস্ত গল্পের বাহারে যার নাম বলছিনা, এড়িয়ে যাচ্ছি, আর ভাবছি এইবার বলেই দি কিন্তু পিছিয়ে যাচ্ছি, তাকে নিয়ে লিখব বলেই এই লেখা ফাঁদা। তাকেও, তাকেও বাঁচানো যায়নি রূপালি মিস আর ছোটোবেলার মত। জ্যান্ত মানুষদের প্রয়োজন পড়লেও সচরাচর আমি সর্বনামেই ডাকি। কিন্তু ছ-ফুট-এক-ইঞ্চির শূন্যস্থানকে কি বলে ডাকতে হয় আমি বুঝিনি এই বছর চারেকে।
মরা মানুষ, প্রিয় মানুষ তোমাকে বলছি, এবারেও পারলাম না, দেখো? মৃত্যুকে লিখতে আমি এখনও শিখিনি। তবু কখনোও, কোনওদিন, শুধু তোমাকে নিয়েই লিখব ঠিক, একটুও ধানাইপানাই না করেই। তোমার তুবড়ির মশলার রসায়ন ফাঁস করে দেব সেইদিন, তোমার প্রিয় গান, প্রিয় কাটলেট, প্রিয় রঙ, প্রিয় বেড়াল, প্রিয় টিভি চ্যানেল, প্রিয় ঘর, প্রিয় মানুষ, সব সব লিখে দেব একদিন। কোনও এক সাতই জুলাই। কোনও এক সাতই জুলাই আমরা বাঁচাতে পারবো তোমাকে।
ততদিন, শূন্যস্থান, ভালো থেকো। অপূর্ণ থেকো।
সে চলে গিয়েছে, তবুও যায়নি / যেমন যায়না আসলে কেউ /
স্টিমার দিয়েছে দিগন্তে পাড়ি / তীরে ফিরে এল অনেক ঢেউ….