খুব ছোটোবেলা থেকেই আমার দুর্গা প্রতিমা দেখলে মন কেমন করত। একগাদা ভারী ভারী হাত, তাতে নানান রাগী তলোয়ার নিয়ে, ইয়া বড় বড় চোখ করে একদৃষ্টে তাকিয়ে রয়েছে একটা বিটকেল দেখতে লোকের দিকে — তাতেই জনতার পুলকের শেষ নেই — একদল যেমন খটমটে অংবং ভাষায় কিছু না কিছু বলেই চলেছে সকাল সন্ধ্যে মূর্তির সামনে বসে, অন্যদল ব্যস্ত নতুন জামা জুতো পরে রং বেরঙের খাবার খেতে। আমাকে এমনিতেও গোলাপি ফেনাওলা কাঠিটা কিনে দেওয়া হত না। ঝিলিকরা ওটাকে বলত বুড়ির চুল। আমি একবার খেতে গিয়ে জামায়, হাতে লাগিয়ে টাগিয়ে এমন চ্যাটচ্যাটে করে ফেলেছিলাম, তারপর থেকেই আর কেউ কিনে দিত না। আমিও বায়না করিনি, চুপচাপ একটা কোণে গিয়ে বড়-চোখ-রাগী-মুখ পুতুলটা দেখতাম। তখন সত্যিই বড্ড কচি বয়স। কষ্ট বলতে কেবল চোখের ভিতর চোখের পাতা প্যাঁচ খেয়ে ঢুকে গেলে কিরিকিরিটা বুঝতাম। আর বাবা একটা দাড়িওয়ালা জেঠুর কথা বলত, খুব ভালো গান গাইতো খালি গলায়, মুক্তর মত হাতের লেখা, নিশ্চয়ই কিছু দুঃখ ছিল মনে, একা একাই মরে গিয়েছিল। প্রথমবার বাজি ধরতে গিয়ে হাত পুড়িয়েছিলাম যেদিন, সেদিন কাদতেঁ কাদতেঁ ওই জেঠুর কথা মনে পড়ছিল — সমস্ত শরীরটাকে পুড়িয়ে ফেলতে নিশ্চই ভীষণ জ্বালা করছিল ওর। তারপর থেকে সঞ্জয় জেঠুর কথা বলতে গেলে বাবার অল্প ধরে যাওয়া গলাটা কানে লাগতো — তখনও কষ্ট হত। খুব স্বাভাবিক জৈবিক নিয়ম মেনেই আমি এরপর বড় হচ্ছিলাম, তাতে এই বিশ্বসংসারের বিশাল কিছু আপত্তি ছিল না। জীবন মাত্রেই বিকাশ ঘটবে — না ঘটলে ডাক্তার-বদ্যি, স্পেসাল-ইস্কুল, টিটকিরি ও সামাজিক প্যাঁক ইত্যাদি — সুতরাং আপত্তির প্রশ্নই উঠছে না, বরং এও একরকমের স্বস্তি। ততদিনে বাজারে নতুন অসুর এসেছে গ্রেগ চ্যাপেল, জান লড়িয়ে মাটি কামড়ে, যুদ্ধে টিকে থাকা কে ডাকতে শিখেছি সৌরভ গাঙ্গুলি, আর ইতি উতি সুইসাইডের কেস শুনলে কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলি এসকেপিস্ট! আর এসব তো শুধু একালের কথা নয়। সেই কোন প্রাগৈতিহাসিক মহাপুরুষ ডারউইনই বলে দিয়েছিলেন যুদ্ধে যেদল হারে, তাদের বলে হেরো, তারা নিশ্চিন্হ হয়। আর, যারা জেতে তাদের জন্য থাকে গালভরা সংস্কৃত মন্ত্র, পরমবীর চক্র, নিদেনপক্ষে শহরের রাস্তা আটকে আবীর-রাঙা মিছিল।
প্রত্যেক যুদ্ধের আগেও একটা ঘটনা থাকে, আমরা তাকে ইতিহাস ডাকি। প্রত্যেক যোদ্ধার যে জীবন, আমরা তার গল্পটুকুই শুনি । কিন্তু সত্যি বলছি, শুধু গল্প শুনে সঞ্জয় জেঠুদের পলাতক বলাটা যেমন অবিচার, তেমনি, দূর্গা ঠাকুর দেখলে আমার আজকাল ভীষণ কষ্ট হয়। ভারী ভারী হাত গড়ে তাতে নানাবিধ অস্ত্র তুলে দেওয়ার আগে কেউ তো একবারও জিজ্ঞেস করেনি, যুদ্ধটা তিনি আদৌ করতে চেয়েছিলেন কিনা!
Khub shundor 🙂
''প্রত্যেক যুদ্ধের আগেও একটা ঘটনা থাকে, আমরা তাকে ইতিহাস ডাকি। প্রত্যেক যোদ্ধার যে জীবন, আমরা তার গল্পটুকুই শুনি''- ভালো লাগল …
Namkoron ta besh laglo..bishoybostur songe nesh joralo vabe manansoyi..subheccha roilo..
দূর্গা ঠাকুর যে সেই choice (সুযোগ টা কিরকম একটা শোনাচ্ছিল) টা কোনদিন ও পায়নি।….
এবং প্রসঙ্গক্রমে: Time Travel করে ফেলেছিস দেখছি।