আমার বাবার ছোটকাকা ইস্কুলের কোনও এক হাফ-ইয়ারলি পরীক্ষাটা ডুব মেরেছিলেন শুধুমাত্র এই বিশ্বাস নিয়েই, যে, বিপ্লব যখন এসেই যাচ্ছে তখন আর কিসের ইস্কুল, কী-ই বা পরীক্ষা। ৪৮-এর সেই গনগনে দিনকালে তখন উচ্চারিত হয়েছে, “ইয়ে আজাদি ঝুটা হ্যায়”, আমার ঠাকুরদা তখন অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির সক্রিয় সদস্য হিসেবে জেল খাটছেন। এরই মধ্যে ডাক উঠল জেলের পাঁচিল ভাঙার — অর্থাৎ বিপ্লব প্রায় বাড়ির উঠোনে দাঁড়িয়ে হাঁক পাড়ছে, এরপর কোন আহাম্মক শেরশাহের বিচারব্যাবস্থা সম্পর্কে টীকা লিখে কৈশোর নষ্ট করে! কিন্তু দোর খুলতেই দেখা গেলো, রক্তে বিপ্লবের মাত্রা যতখানি তুঙ্গে, রাষ্ট্রযন্ত্রের ক্ষমতা ও জহরকোটের শুভ্রতায় তার প্রভাব ততখানি নয়। এইসব, সমস্তই, আমার শোনা কথা আর পড়া ছাপা অক্ষর থেকে। বেশ ছোটো থেকেই দাদাই, মানে আমার ঠাকুরদা, সাল উল্লেখ করে বেশ গুছিয়ে কত গল্প বলতেন মনে আছে। দারিদ্র্যের গল্প, যখন খেতে পাওয়া নিয়ে ভাবতে হয়েছে; তারপর জেলে থেকে অনসনের গল্প, যখন ৩৯ দিন খাদ্যকে অস্বীকার করেছেন। কি জানি, হয়তো সেই থেকেই কখনোও খুব ছোটো বয়সেও হাড় হিম করা সব ভুতের গল্প আমার কাছে বিশেষ রোমাঞ্চের ঠেকেনি। তবে এই সব গল্পের আড়ালে আমার প্রশ্নটা থেকেই যেত, তাহলে এবারেও বিপ্লবটা হলো না, ৪৮-এ না, ৬৭ তে না, ৭১-এও না? দাদাই বলেছে, “হবে।” আমার প্রশ্ন আমি উচ্চারণ করিনি কখনোওই, দাদাইয়ের উত্তরও ছিল সাংকেতিক। তাই অভ্যাস থেকেই বলছি, শুনে নিন, ৩০ জুলাই ২০১৫ তে বাজেশিবপুরে যুবক সমিতির কর্মকাণ্ড সংকেত দিয়েছে, “হবে”।
জুন মাসের মাঝামাঝি ঠিক করা হয়েছিলো, জুলাই মাসের ৩০ তারিখে নবারুণের উপর বানানো কিউয়ের ডকুমেন্টারির একটা স্ক্রিনিং ঘটবে হাওড়ার বাজেশিবপুরে যুবক সমিতি ক্লাবের ঘরে। হাওড়া এর আগে খুব পরিচিত ছিলো না আমার কাছে কখনোওই। কয়েক সপ্তাহ আগে তখন ৩০ তারিখের তোরজোড় সবে শুরু, হাওড়াও তখন থেকেই জানান দিতে শুরু করে। কিন্তু কি আশ্চর্য, বেশ কিছু সন্ধ্যেবেলা, বেশ কিছু গলিতেই আমার মনে হয়েছে যেন কোন এক সুত্র ধরে চেনা। এ ভারী মজার ব্যাপার, চন্দননগরের যে বস্তি অঞ্চলের সাথে মাখামাখি দিয়ে আমার বড় হয়ে ওঠা সেই ঝুপড়ি ঘর গুলোর অনেক গুলোতেই এখনোও সহজ পাঠও প্রবেশ করেনি, ইলেক্ট্রিসিটিই ঢুকেছে এই হালে। সুতরাং নবারুণ ভট্টাচার্য ও তার উপস্থিতি সেখানে ভীষণই অকিঞ্চিৎকর এক ঘটনা। কিন্তু ক্লাস সিক্স কি সেভেনে যখন পড়ছি, তখন হার্বাট হাতে নিয়ে দেখলাম অদ্ভুত চেনা চেনা ঠেকছে। বস্তুতই আমার জ্ঞানে ততদিনে যেটুকু খিস্তির সমারহ সমস্তই ইমিডয়েট পারিপার্শ্বিক থেকে যত্নে ও অযত্নে সংগৃহীত। এই নিয়ে অনেক কথা বলা যায়, তবে যেটুকু বলার, আমি নবারুণ কে চিনেছি এই চারপাশ দিয়ে, আর এই যে এতদিনের চেনা চারপাশটাকে নতুন করে আরও আরও আবিষ্কার করতে শিখেছিলাম নবারুণকে দিয়ে। আর হাওড়ার অলি গলি চিনতে শুরু করেছি খানিকটা এই এত দিনের চিনতে পারার অভ্যাস দিয়ে।
ঠিক হল, ছবিটা দেখানোর সাথে সাথেই কিছু আরও কর্মসূচী নেওয়া হবে। সম্বরণ দেওয়ালে লিখবে নবারুণের কথা, কাব্য ও আরোও নানা বিস্ফোরক। ল্যাম্পপোস্টের মাথায় লাগানো হবে চোঙা আর তাতে নবারুণের কন্ঠ বলে চলবে কবিতাগুলো, এক-একটা বাড়ির দেওয়ালে প্রোজেকশন করে দেখানো হতে থাকবে বিভিন্ন স্টিল ছবি, ভিডিও লুপ। একটা বেশ বুথ তৈরী হবে, বেবি কে’র বুথ, একটা টেবিলের এক কোনায় রাখা থাকবে এক বোতল পেট্রল আর বাংলা। আর টেবিলের উপর থাকবে ল্যাপটপ, হেডসেট দিয়ে শোনা যাবে বেবি কে’র কিছু অংশ পাঠ করেছেন জয়রাজ আর সুরজিত। আর থাকবে পোষ্টার, মন্দিরতলা থেকে যুবক সমিতি আসার রাস্তাটা আমরা ঠিক করলাম ভরিয়ে দেবো পোষ্টারে আর এন্যারকিস্ট ফ্ল্যাগে! ডিজাইন করবেন দেবিকা দাভে; গোল চশমা পড়া মেয়েটা বড় হয়েছে কিন্তু দিল্লিতে আর কলেজ ব্যাঙ্গালোরে, বাংলা জানে না। অথচ ২৮ তারিখ রিক্সায় আসতে আসতে আমাকে বলল, “এই যে কেমন দেখ একটা পুরোনো ক্ষয়ে যাওয়া বাড়িটার পাশে একটা চকচকে ফ্ল্যাট, এইটা দেখতে পাবো না বলেই বোধহয় আর ব্যাঙ্গালোরে ফেরা গেলো না।”
যুবক সমিতি বলে কোনও পাড়ার ক্লাবে একটা ছবির স্ক্রিনিং হচ্ছে এরম কথা আর কেই বা কত শুনেছে। তেমনি আমি নিজেও যে “যুবক সমিতি”তে ব্যক্তিগতভাবে এত সময় কাটাবো এটাও একটা চমক এই নারীবাদী মেরুদণ্ডের কাছে। ২৯’এ আমি যখন হাওড়া গেলাম, গিয়ে দেখলাম গুচ্ছ পোষ্টার লাগানো হয়ে গিয়েছে, পছন্দের দেওয়ালগুলোতে চুনকাম শেষ, আর সম্বরণ বৃষ্টি মাথায় করেই কত দেওয়াল লিখে ফেলেছে অনেকটাই। ওই গলিটা দিয়ে তো আগেও ঢুকছি, ওই চায়ের দোকানের সামনেও যে আগে দাঁড়াইনি এমন তো নয়, কিন্তু তখন সামনের দেওয়াল জুড়ে লেখা থাকতো না, “ভীতু মানুষের পাশ থেকে যে কবিতা সরে যায়, সেই কবিতা আসলে ভীতু।” মাঝে মাঝে যেমন মনে হয়, রাস্তা দিয়ে চলতে চলতে হঠাৎ বেশ একটা মানানসই ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর দরকার ছিলো জীবনে, এইদিন চা-টা হাতে নিয়ে সামনে তাকিয়ে ওই দেওয়ালটা দেখে ঠিক উল্টো মনে হচ্ছিল। মনে হলো, সব শব্দ আর আওয়াজ আর কোলাহল কিছুক্ষণের জন্য নেই, খালি দেওয়াল জুড়ে আছে অক্ষর অনেক যত্নে লেখা, আর তাকে ঘিরে পোষ্টার, এনার্কির A কে জড়িয়ে আছে অর্ডারের O। ঠিক এই রকম নৈঃশব্দ্যই নেমে আসে বিস্ফোরণের আগে, ঠিক এই রকম নৈঃশব্দ্য দিয়েই তো আমার কমরেড বলে দেন, “হবে”।
দেওয়াল চুনকাম করে ফেলেছিলেন পাল দা, নোটন দা, প্ররেনাটারা মিলে রাত জেগে। জয়রাজ আলাপ করিয়ে দিয়েছিলেন বলে ক্লাবের এই মুখ গুলো কে আমি ও’র ডাকেই ডাকতে থাকি এই ক’দিন। যা মনে হচ্ছে এই রকমই চলবেও। পুরো নাম গুলো জানিনা, কোনোদিন জানবো অথবা জেনে খুব উদ্ধার হবে এমন সম্ভাবনাও দেখছি না। হাওড়ার এই গলির আনাচ কানাচ থেকে আত্মীয়তা গজায়, এ কথা আমি একটুও বাড়িয়ে বলছিনা। শুধুমাত্র আত্মিক যোগ দিয়েও বৃষ্টিকে এইভাবে রুখে দিয়ে সারা রাস্তার প্রায় সমস্ত দেওয়াল পোষ্টারে ভরে দেওয়া যায় না, আগের রাতটা প্রায় জেগে প্রোজেকশনের সমস্ত ব্যবস্থাটুকু অবধি অক্লান্ত খেটে যাওয়া যায় না। কমিটমেন্ট প্রয়োজন, তা রাজনীতিরই হোক অথবা বন্ধুত্বের।
তমোঘ্ন ২৯ তারিখ জানালেন ও একটা পারফর্মেন্স কন্ট্রিবিউট করতে চায় এই ব্যবস্থায়। পুনা ফিল্ম ইন্সটিটিউট-এর নব কর্ণধার নিযুক্ত হয়েছেন গজেন্দ্র চৌহান, এই নিয়োগের পিছনে ভারত সরকারের যাবতীয় যুক্তিকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে চলেছে ছাত্র ছাত্রীরা আজ বহুদিন হয়ে গেলো। অথচ, ভারতীয় জনতা পার্টি তথা মোদী সরকার মেজরিটির দোহাই দিয়ে চাপিয়েই দিয়ে চলেছেন একের পর এক ঘটনা দেশের উপর। চৌহান তার একটা উদাহরণ, এবং যথেষ্ট এলার্মিং-ও বটে। ৩০ তারিখ বিকেল ৫:৩০ থেকে তমোঘ্নোর পোষাক বলতে ছিল গেরুয়া রঙের স্কার্ট সদৃশ যে কাপড়টা তার তিনটে অংশে আনন্দবাজারও বিরাজ করছে। তমোঘ্নর হাতে ছিল একটা বোর্ড যাতে লেখা, বড় বড় অক্ষরে, “Kick my ass” — তমোঘ্ন লাথি দাবী করছিলেন উপস্থিত ক্রাউডের কাছে গিয়ে, একেক জনের কাছ থেকে, আর লাথিটা পড়ছিলো আনন্দবাজারে, গেরুয়ায়, স্বৈরতন্ত্রে, স্বেচ্ছাচারীতায়, আর আমাদের কাপুরুষতায়।
ছবিটা দেখানো হয়েছিলো সেদিন। সেদিন হাওড়ার অলিগলি থেকে শোনা গিয়েছিলো, “এখনই কবিতা লেখা যায়”, গলির বাঁকে যে বাড়ির দেওয়াল এতদিন গ্রাহ্য করার প্রয়োজন পড়েনি, তাতেই ফুটে উঠেছিলো নবারুণের ছবি, নবারুণ হাসছেন, অসম্ভব সাংকেতিক সেই হাসি। অভ্যাস থেকেই বলছি, বিশ্বাস করুন, নবারুণ বলেছেন, “হবে”।
লেখাটি প্রাথমিক ভাবে “বাংলাব্ল্যাক” নামক আর্কাইভ ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয় ২৮ আগস্ট, ২০১৫ তে ।